শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ – এর পাঁচালী
যন্ময়া ভক্তিযোগেন পত্রং পুষ্পং ফলং জলম্।
নিবেদিতঞ্চ নৈবেদ্যং তদ্গৃহাণানুকম্পয়া ।।
ত্বদীয়ং বস্তু গোবিন্দ তুভ্যমেব সমর্পয়ে।
গৃহাণ সুমুখো ভুত্বা প্রসীদ পুরুষোত্তম।।
মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তু মে।।
অমোঘং পুণ্ডরীকাক্ষং নৃসিংহং দৈত্যসূদনম্।
হৃষীকেশং জগন্নাথং, বাগীশং বরদায়কম্।।
সগুণঞ্চ গুণাতীতং, গোবিন্দং গরুড়ধ্বজম্।
জনার্দ্দনং জনানন্দং জানকীবল্লভং হরিম্।।
প্রণমানি সদা ভক্ত্যা নারায়ণমতঃপরম্।
দুর্গমে বিষমে ঘোরে, শত্রুণা পরিপীড়িতে।।
নিস্তারয়তু সর্ব্বেষু তথানিষ্টভয়েষু চ।
নামান্যেতানি সংকীর্ত্ত্য ঈপ্সিতং ফলমাপ্নুয়াৎ।।
সত্যনারায়ণং দেবং বন্দেঽহং কামদংপ্রভুম্।
লীলয়া বিততং বিশ্বং যেন তস্মৈ নমো নমঃ।।
শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ-এর পাঁচালীর স্তুতির ব্যাখ্যা
এই স্তোত্রটি শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ দেবের প্রতি ভক্তিভাবপূর্ণ প্রশস্তি এবং প্রার্থনা। এখানে ভক্তের শুদ্ধ চিত্তে নিবেদিত উপহার গ্রহণ করার অনুরোধ, ঈশ্বরের অনন্ত মহিমা, এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণের বার্তা রয়েছে।
শ্লোকের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা
🔹 "যন্ময়া ভক্তিযোগেন পত্রং পুষ্পং ফলং জলম্।
নিবেদিতঞ্চ নৈবেদ্যং তদ্গৃহাণানুকম্পয়া।।"
➡️ ভক্তি সহকারে যে পত্র (পাতা), পুষ্প (ফুল), ফল বা জল আমি নিবেদন করি, হে প্রভু, তা করুনাপূর্ণ দৃষ্টিতে গ্রহণ করুন।
➡️ এই শ্লোকটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার (৯.২৬) প্রসিদ্ধ শ্লোকের অনুরূপ, যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, ভক্তিভাবে নিবেদিত যেকোনো সামান্য উপহারও তিনি গ্রহণ করেন।
🔹 "ত্বদীয়ং বস্তু গোবিন্দ তুভ্যমেব সমর্পয়ে।
গৃহাণ সুমুখো ভুত্বা প্রসীদ পুরুষোত্তম।।"
➡️ হে গোবিন্দ! যা কিছু আমার আছে, তা সবই তোমারই দান। আমি তা তোমাকেই সমর্পণ করছি।
➡️ হে পুরুষোত্তম! অনুগ্রহ করে প্রসন্ন মনে আমার এই নিবেদন গ্রহণ করুন।
🔹 "মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তু মে।।"
➡️ হে জনার্দন! আমার পূজা যথাযথ মন্ত্র, শুদ্ধাচার বা নিখুঁত আনুষ্ঠানিকতা (ক্রিয়া) ছাড়াই হতে পারে, এমনকি যথেষ্ট ভক্তিও থাকতে পারে না।
➡️ তবুও, আমি তোমার দয়ায় আশীর্বাদ চাই, যেন আমার পূজা পরিপূর্ণ হয়।
➡️ এই শ্লোকটি ঈশ্বরের করুণার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রকাশ।
🔹 "অমোঘং পুণ্ডরীকাক্ষং নৃসিংহং দৈত্যসূদনম্।
হৃষীকেশং জগন্নাথং, বাগীশং বরদায়কম্।।"
➡️ ভগবান সত্যনারায়ণ হলেন পুণ্ডরীকাক্ষ (পদ্মনয়নী, বিষ্ণুর আরেক নাম), নৃসিংহ (দৈত্য-নাশক), হৃষীকেশ (ইন্দ্রিয়দের অধিপতি), জগন্নাথ (সমগ্র জগতের অধিপতি), এবং বরদায়ক (বরদানকারী)।
➡️ এই শ্লোকের মাধ্যমে সত্যনারায়ণের বিভিন্ন রূপ ও নাম বন্দনা করা হয়েছে।
🔹 "সগুণঞ্চ গুণাতীতং, গোবিন্দং গরুড়ধ্বজম্।
জনার্দ্দনং জনানন্দং জানকীবল্লভং হরিম্।।"
➡️ সত্যনারায়ণ সগুণীও (যিনি বিভিন্ন গুণাবলীর অধিকারী) এবং গুণাতীতও (যিনি সকল গুণের ঊর্ধ্বে)।
➡️ তিনি গোবিন্দ (যিনি গোপ ও ইন্দ্রিয়দের পালন করেন), গরুড়ধ্বজ (যাঁর পতাকা গরুড় চিহ্নিত), জনার্দ্দন (সকল জীবের কষ্টনাশক), জনানন্দ (সকলকে আনন্দদায়ক), জানকীবল্লভ (সীতার স্বামী), এবং হরি (যিনি পাপ ও দুঃখ বিনাশ করেন)।
🔹 "প্রণমানি সদা ভক্ত্যা নারায়ণমতঃপরম্।
দুর্গমে বিষমে ঘোরে, শত্রুণা পরিপীড়িতে।।
নিস্তারয়তু সর্ব্বেষু তথানিষ্টভয়েষু চ।"
➡️ আমি চিরদিন ভক্তিভরে নারায়ণকে প্রণাম করি।
➡️ দুর্গম (কঠিন) অবস্থায়, সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে, শত্রুদের অত্যাচারে ও ভয়াবহ বিপদে তিনি যেন আমাদের উদ্ধার করেন।
🔹 "নামান্যেতানি সংকীর্ত্ত্য ঈপ্সিতং ফলমাপ্নুয়াৎ।।
সত্যনারায়ণং দেবং বন্দেঽহং কামদংপ্রভুম্।"
➡️ যদি কেউ এই সমস্ত নাম উচ্চারণ করে সংকীর্তন করে, তবে সে তার ইচ্ছিত ফল লাভ করবে।
➡️ সত্যনারায়ণ দেবের বন্দনা করি, যিনি ইচ্ছা পূরণকারী এবং সকল কষ্ট দূরকারী।
🔹 "লীলয়া বিততং বিশ্বং যেন তস্মৈ নমো নমঃ।।"
➡️ যিনি লীলার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে বিস্তৃত করেছেন, সেই সত্যনারায়ণকে বারংবার প্রণাম।
➡️ এখানে সত্যনারায়ণকে সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উপসংহার
এই স্তোত্রটি শ্রী সত্যনারায়ণ ব্রত এবং পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতে ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ, তাঁর মহিমা কীর্তন, এবং ভক্তের কাতর প্রার্থনা ফুটে উঠেছে। শাস্ত্র মতে, শ্রী সত্যনারায়ণের নাম জপ, সংকীর্তন ও উপাসনা করলে ভক্তের সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয় এবং জীবনের সকল সংকট দূর হয়।
🔹 মূল বার্তা:
➡️ ঈশ্বরের প্রতি একাগ্রতা ও ভক্তি থাকলে তিনি যে কোনো উপাসনা গ্রহণ করেন।
➡️ সত্যনারায়ণের নাম সংকীর্তন করলে সকল কামনা পূর্ণ হয়।
➡️ সকল বিপদ ও দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভগবান নারায়ণের আশ্রয় নেওয়া উচিত।
এই স্তুতিতে যে গভীর ভক্তি ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ ঘটেছে, তা শ্রী সত্যনারায়ণ পূজার অন্যতম মূল ভিত্তি। 🙏
ওঁ নমস্তে বিশ্বরুপায়, শঙ্খচক্রধরায় চ।
পদ্মনাভায় দেবায়, হৃষিক-পতয়ে নমঃ।।
নমোহনন্তস্বরূপায়, ত্রিগুণাত্মবিভাসিনে।
এষ পুষ্পাঞ্জলিঃ ওঁ সত্যনারায়ণায় নমঃ।।
কামাখ্যারে করি নতি ধর্ম্মরাজ-যুতা।
সসর্প মনসা বন্দোঁ মহেশের সুতা।।
অষ্ট সিদ্ধি নবগ্রহ দশদিক্পাল।
বন্দোঁ বর্ণ পঞ্চাশৎ পরম রসাল।।
কূর্ম্মানন্ত অবনী অম্বুধি অষ্টাচল।।
ত্রৈলোক্য তারিণী বন্দোঁ তুলসী-সুন্দরী।
গোলোক প্রভৃতি বন্দোঁ চতু্র্দ্দশ পুরী।।
গঙ্গা আদি তীর্থক্ষেত্রে হইয়া দণ্ডবৎ।
কামরূপ আদি বন্দোঁ পীঠ পঞ্চাশৎ।।
দশ মহাবিদ্যা বন্দোঁ দশ অবতার।।
গোকুলে গোবিন্দ বন্দোঁ গোবর্দ্ধন-ধারী।
প্রণমিব প্রভুর প্রেয়সী যত নারী।।
ব্রহ্মাদ্যাদি সৰ্ব্বশক্তি পরা শক্তি দাত্রী ।
চন্ডচামুন্ডা চন্ডিকা দুর্গা শিবদূতী ।।
অপ্সরী কিন্নরী বন্দোঁ ডাকিনী যােগিনী ।
ছয় রাগ ছয় ঋতু ছত্রিশ রাগিনী ।।
বন্দো বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত বিদ্যাগণ ।
যত ব্ৰহ্ম ঋষি দেব মুনির চরণ ।।
ত্রিদশের চতুর্দশ ভূবনের ভূপ ।।
সুফি খাঁ পীরের পায় প্রচুর প্রণতি ।।
সাত শত আউলিয়া বন্দি কর জোড়ে ।
ফণীন্দ্র নগেন্দ্র ইন্দ্র কাপে যা’র ডরে ।।
জয় জয় সত্যপীর, সনাতন দস্তগীড়,
কে জানে তােমার তত্ত্ব, তুমি রজঃ তমঃ সত্ত্ব
সৰ্ব্বভূতে সৰ্বময়, চারু চরাচরচয়,
চন্দ্রচূড় – চিন্ত্য চিন্তামণি ।
পূৰ্বে হয়ে দশমূৰ্ত্তি, করিলে অকথ্য কীর্তি,
ছয় দরশনে কয়, এক ব্ৰহ্ম দুই নয়,
কলিতে যবন দুষ্ট, হৈন্দবী করিল নষ্ট,
ভক্তের কারণে হরি, রহিমের বেশ ধরি,
ব্রাহ্মণে বলিয়া ভেদ, ঘুচালে মনের খেদ,
এক মনে অল্প ধনে, যে তােমারে সির্ণি মানে,
আমি অতি মূঢ় মতি কি জানি ভকতি স্তুতি,
তােমার সেবাতে হয় হৃদয়ের গ্রন্থি ক্ষয়,
সদানন্দে হয়ে লীন তােমার প্রেমেরধীন,
দরিদ্র দ্বিজের কাছে, পূৰ্ব্বকালে সৰ্ত্ত আছে
নায়কেরে হ’য়ে তুষ্টি সির্ণিতে করহ দৃষ্টি,
দুঃখ বিনাশিনী তথা, তােমার মঙ্গল কথা,
যে গায় গাওয়ায় কিংবা শােনে ।
তুমি রক্ষা কর তারে মহামারে মহাঘােরে
দৃঢ়ভক্তি হয় যার, পাতক না থাকে তার
ভক্তির নিবেদন ও সত্যনারায়ণের কৃপা
এই স্তবগীতি সত্যনারায়ণের প্রতি এক নিবেদনমূলক প্রার্থনা, যেখানে ভক্ত তাঁর অজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধতার স্বীকারোক্তি দিয়ে ঈশ্বরের কৃপা ও দয়া কামনা করেছেন। এটি ভক্তি, আত্মসমর্পণ ও ঈশ্বরের করুণার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে।
শ্লোক ব্যাখ্যা
🔹 "আমি অতি মূঢ় মতি, কি জানি ভকতি স্তুতি,
নিজ গুণে পূর গুণধাম।।"
➡️ আমি অত্যন্ত মূর্খ ও নির্বোধ, তাই ভক্তি বা স্তবগান সম্পর্কে কিছুই জানি না।
➡️ তবুও, হে গুণধাম (গুণের আধার), তুমি নিজ গুণে আমার পূজাকে গ্রহণ করো।
🔹 "তােমার সেবাতে হয়, হৃদয়ের গ্রন্থি ক্ষয়,
তােমা বিনা কিছু নাহি জানে।।"
➡️ তোমার সেবায় অন্তরের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়।
➡️ যে তোমার উপাসনায় লীন, সে আর কিছু জানে না—শুধু তোমাতেই একীভূত হয়।
🔹 "সদানন্দে হয়ে লীন, তােমার প্রেমের ধীন,
পরাপর সেবাগত ধ্যানে।।"
➡️ ভক্ত চিরআনন্দে লীন হয়ে যায়, তোমার প্রেমের বাঁধনে আবদ্ধ হয়।
➡️ এবং চূড়ান্ত ধ্যানে, পরম সেবায় রত থাকে।
🔹 "দরিদ্র দ্বিজের কাছে, পূৰ্ব্বকালে সৰ্ত্ত আছে
আত্মবাক্য পালিবে আপনি।।"
➡️ পূর্বকালে দরিদ্র দ্বিজ (ব্রাহ্মণ) তোমার প্রতি যে শপথ বা সংকল্প করেছিল, তুমি নিজেই তা পালন করেছিলে।
➡️ এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে ভক্ত যদি তাঁর শরণ নেয়, তাহলে তিনি কখনো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না।
🔹 "নায়কেরে হ’য়ে তুষ্টি, সির্ণিতে করহ দৃষ্টি,
শুন আপনার ব্রত বাণী।।"
➡️ যদি কেউ সামান্য প্রসাদ (সির্ণি) দিয়েও তোমার সন্তুষ্টি কামনা করে, তুমি কৃপাদৃষ্টি দাও।
➡️ এটি সত্যনারায়ণ ব্রতের মূল তত্ত্বের প্রতিফলন, যেখানে সামান্য দান ও ভক্তিই পরম ফল প্রদান করে।
🔹 "দুঃখ বিনাশিনী তথা, তােমার মঙ্গল কথা,
যে গায় গাওয়ায় কিংবা শােনে।।"
➡️ যে তোমার মঙ্গলময় কথা গায়, গাওয়ায় বা শ্রবণ করে, তার সমস্ত দুঃখ বিনাশ হয়।
➡️ এখানে সত্যনারায়ণ কীর্তনের মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে।
🔹 "তুমি রক্ষা কর তারে, মহামারে মহাঘােরে,
রণে, বনে, রিপু সন্নিধানে।।"
➡️ তুমি তাঁর রক্ষা করো—যে মহামারি, মহাসঙ্কট, যুদ্ধ, বনে বা শত্রুর নিকটে বিপদগ্রস্ত হয়।
➡️ এটি ঈশ্বরের সর্বত্র উপস্থিতি ও তাঁর আশ্রয়ের শক্তি বোঝায়।
🔹 "দৃঢ়ভক্তি হয় যার, পাতক না থাকে তার
মনােরথ সিদ্ধি হাতে হাতে।।"
➡️ যার দৃঢ় ভক্তি আছে, তার কোনো পাপ থাকে না।
➡️ তার সমস্ত ইচ্ছা দ্রুত পূর্ণ হয়।
🔹 "কহে দ্বিজ রামেশ্বর, শুদ্ধভাবে শুন নর,
হরি বল পীরের পীরিতে।।"
➡️ দ্বিজ রামেশ্বর বলছেন, হে মানুষ! শুদ্ধ মনে এই কথা শুনো।
➡️ ভগবান হরির নাম করো, কারণ তিনিই পীরদেরও পীর, সর্বোচ্চ মহাপুরুষ।
মূল বার্তা
✅ ভক্তি ও আত্মসমর্পণের গুরুত্ব:
➡️ ভক্ত যতই অজ্ঞ বা সাধারণ হোক না কেন, যদি সে ঈশ্বরের শরণ নেয়, তাহলে সত্যনারায়ণ তার রক্ষা করবেন।
✅ সত্যনারায়ণ ব্রতের মাহাত্ম্য:
➡️ সামান্য প্রসাদ (সির্ণি) নিবেদন করলেও সত্যনারায়ণ প্রসন্ন হন।
✅ কীর্তনের শক্তি:
➡️ সত্যনারায়ণের নাম গাওয়া, শুনা বা প্রচার করলে সমস্ত দুঃখ, বিপদ দূর হয়।
✅ সঙ্কট থেকে মুক্তি:
➡️ সত্যনারায়ণের আশ্রয়ে থাকলে, যুদ্ধে, বনে, মহামারিতে বা শত্রুর সামনে কেউ ভয় পায় না।
✅ পাপ বিনাশ ও মনোবাঞ্ছা পূরণ:
➡️ দৃঢ় ভক্তির মাধ্যমে সমস্ত পাপ নাশ হয় এবং ইচ্ছাগুলো দ্রুত পূর্ণ হয়।
এই স্তোত্রটি সত্যনারায়ণের প্রতি গভীর বিশ্বাস, ভক্তির মাহাত্ম্য ও তাঁর অসীম কৃপা প্রকাশ করে। 🙏
সিৰ্ণি দিয়ে শুদ্ধ ভাবে, পূজিলে বাঞ্ছিত লভে
পুত্র, দারা, অর্থ, ঘােড়া, দোলা ।
ভনে দ্বিজ রামেশ্বর, বুঝে কাৰ্য্য কর নর,
কলিতে প্রথম তত্ত্ব ফকিরত্ব কায়া ।
দ্বিতীয়ে দরিদ্র দ্বিজে দিলে পদ ছায়া ।।
তৃতীয়ে ত্রিবিধ লােক করিলে নিস্তার ।
চতুর্থে উৎকট কষ্ট নষ্ট কাঠুরার ।।
কন্যা জন্য মাননে পঞ্চমে পরাৎপর ।
সদানন্দ সাধুকে সংকটে দিলা বর ।।
যষ্ঠে তুষ্ট হয়ে কষ্ট দূর কৈলা শেষে ।।
কত ঠাঁই ঠাকুরালী করিয়া প্রচুর ।
দরিদ্রের দুঃখ ক্লেশ কত কৈলা দূর ।।
বংশধ্বজ নৃপতির দর্প চূর্ণ করি ।
গােপগণ সঙ্গে পূজা করাইলা হরি ।।
সত্যনারায়ণ ব্রতের মাহাত্ম্য ও অষ্ট মঙ্গলা কাহিনী
এই স্তোত্রটি সত্যনারায়ণের পূজার ফল এবং তাঁর কৃপা কাহিনীগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করে। এখানে আটটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা "অষ্ট মঙ্গলা" তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে সত্যনারায়ণের কৃপায় ভক্তরা মুক্তি পেয়েছে এবং ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।
পূজার মাহাত্ম্য
🔹 "সিৰ্ণি দিয়ে শুদ্ধ ভাবে, পূজিলে বাঞ্ছিত লভে
পুত্র, দারা, অর্থ, ঘোড়া, দোলা।"
➡️ যদি কেউ শুদ্ধভাবে সির্ণি (সত্যনারায়ণের প্রসাদ) নিবেদন করে পূজা করে, তবে সে তার মনোবাসনা লাভ করে—পুত্র, স্ত্রী, ধন, বাহন (ঘোড়া, দোলার মতো সমৃদ্ধি)।
🔹 "ভনে দ্বিজ রামেশ্বর, বুঝে কাৰ্য্য কর নর,
শুন প্রভুর অষ্ট মঙ্গলা।।"
➡️ দ্বিজ রামেশ্বর বলছেন—হে মানুষ! বুঝে কাজ করো, প্রভুর অষ্ট মঙ্গলার কাহিনি শ্রবণ করো।
অষ্ট মঙ্গলা: সত্যনারায়ণের আটটি কৃপা কাহিনি
১️⃣ প্রথম মঙ্গল:
🔹 "কলিতে প্রথম তত্ত্ব ফকিরত্ব কায়া।"
➡️ কলিযুগে সত্যনারায়ণ প্রথমবার তাঁর মহিমা প্রকাশ করেন ফকির রূপে।
২️⃣ দ্বিতীয় মঙ্গল:
🔹 "দ্বিতীয়ে দরিদ্র দ্বিজে দিলে পদ ছায়া।।"
➡️ দরিদ্র ব্রাহ্মণের কষ্ট দূর করে তাকে আশ্রয় দেন।
৩️⃣ তৃতীয় মঙ্গল:
🔹 "তৃতীয়ে ত্রিবিধ লােক করিলে নিস্তার।।"
➡️ তিন ধরনের মানুষ—দরিদ্র, গৃহস্থ ও রাজা—সত্যনারায়ণের কৃপায় উদ্ধার পান।
৪️⃣ চতুর্থ মঙ্গল:
🔹 "চতুর্থে উৎকট কষ্ট নষ্ট কাঠুরার।।"
➡️ কাঠুরিয়া একদিন সত্যনারায়ণের প্রসাদ গ্রহণ করে এবং তার সকল দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়।
৫️⃣ পঞ্চম মঙ্গল:
🔹 "কন্যা জন্য মাননে পঞ্চমে পরাৎপর।।"
➡️ এক ধনী ব্যক্তি সত্যনারায়ণের কৃপায় তার কন্যার জন্য উপযুক্ত বর পায়।
৬️⃣ ষষ্ঠ মঙ্গল:
🔹 "সদানন্দ সাধুকে সংকটে দিলা বর।।"
➡️ সদানন্দ নামে এক সাধু সংকটে পড়লে সত্যনারায়ণ তাকে কৃপাদৃষ্টি দেন।
🔹 "পাসরণে প্রতিফল বন্ধন বিদেশে।।
ষষ্ঠে তুষ্ট হয়ে কষ্ট দূর কৈলা শেষে।।"
➡️ ষষ্ঠ ঘটনায় সত্যনারায়ণ এক বিদেশী ব্যবসায়ীর বন্ধনমুক্তি ও দুঃখ নিবারণ করেন।
৭️⃣ সপ্তম মঙ্গল:
🔹 "সপ্তমে সাধুর সঙ্গে পথে দরশন।।"
➡️ এক সাধু পথে চলার সময় সত্যনারায়ণের দর্শন পান, যা তার ভাগ্য পরিবর্তন করে।
৮️⃣ অষ্টম মঙ্গল:
🔹 "অষ্টমে অবলার অহংকার মোচন।।"
➡️ এক গর্বিত নারী সত্যনারায়ণের কৃপায় অহংকার ত্যাগ করে এবং মুক্তি লাভ করে।
অন্য ঘটনার উল্লেখ
🔹 "কত ঠাঁই ঠাকুরালী করিয়া প্রচুর।
দরিদ্রের দুঃখ ক্লেশ কত কৈলা দূর।।"
➡️ সত্যনারায়ণ বহু জায়গায় ভক্তদের দুঃখ মোচন করেছেন এবং তাদের কষ্ট লাঘব করেছেন।
🔹 "বংশধ্বজ নৃপতির দর্প চূর্ণ করি।
গোপগণ সঙ্গে পূজা করাইলা হরি।।"
➡️ অহংকারী রাজা বংশধ্বজের অহংকার চূর্ণ করে সত্যনারায়ণ তাঁর প্রকৃত শক্তি দেখান এবং গোপগণের সঙ্গে পুজা করেন।
মূল শিক্ষা ও বার্তা
✅ সত্যনারায়ণ পূজার ফল:
➡️ শুদ্ধ চিত্তে সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করলে মানুষ ধন-সম্পদ, পুত্র, স্ত্রী, সুখ-শান্তি লাভ করে।
✅ অহংকারের বিনাশ:
➡️ অহংকারী ব্যক্তি সত্যনারায়ণের কৃপায় নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং পরিশুদ্ধ হয়।
✅ দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি করুণা:
➡️ সত্যনারায়ণ দরিদ্রদের দুঃখ দূর করেন এবং তাদের জীবন সমৃদ্ধ করেন।
✅ ভক্তির মাহাত্ম্য:
➡️ যাঁরা সত্যনারায়ণের উপাসনা করেন, তাঁরা সব সংকট থেকে মুক্ত হন এবং তাদের ইচ্ছা পূর্ণ হয়।
এই স্তোত্রটি সত্যনারায়ণের অষ্ট মঙ্গলা কাহিনি ও তাঁর করুণার গুরুত্ব বোঝায়, যা ভক্তদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার জন্ম দেয়। 🙏
পরে তুষ্ট হয়ে তারে দিলে পরম স্থান ।
পুত্ৰার্থীরে পুত্র দেয় ধনার্থীরে ধন ।
দয়াৰ্থী সদাই সেবে সত্যের চরণ ।।
তুমি প্রভু দয়াসিন্ধু মহিমা সাগর ।
কি বলিতে পারি প্রভু আমি তুচ্ছ নর ।।
মাের দোষ ক্ষম, দেহ চরণে শরণ ।।
নায়কে কল্যাণ কর গায়কে সুস্বর ।
পূজার দক্ষিণা দিবে, না হবে কাতর ।
তবে দয়া করিবেন পীর পয়গম্বর ।।
সত্যনারায়ণ ব্রতের পরম ফল ও দয়ার নিদান
এই স্তোত্রটি সত্যনারায়ণের দয়া, ভক্তদের প্রতি তাঁর কৃপা, এবং ব্রতের মাহাত্ম্য তুলে ধরে। এখানে বলা হয়েছে, সত্যনারায়ণ ব্রত পালনের মাধ্যমে ভক্তরা সকল ইচ্ছা পূরণ করতে পারে এবং পরম মোক্ষ লাভ করতে পারে।
সত্যনারায়ণের দয়ার কৃপা
🔹 "পরে তুষ্ট হয়ে তারে দিলে পরম স্থান।
সত্যনারায়ণ হন দয়ার নিদান।।"
➡️ সত্যনারায়ণ ভক্তদের তুষ্ট হয়ে তাঁদের পরম মোক্ষ প্রদান করেন। তিনি দয়ার আধার।
🔹 "পুত্রার্থীরে পুত্র দেয় ধনার্থীরে ধন।
দয়াৰ্থী সদাই সেবে সত্যের চরণ।।"
➡️ যারা সন্তান কামনা করে, তারা পুত্র লাভ করে, যারা ধন চায়, তারা ধন লাভ করে।
➡️ দয়ার্থীরা সর্বদা সত্যনারায়ণের চরণ সেবা করে এবং কৃপা লাভ করে।
সত্যনারায়ণের অনন্ত করুণা
🔹 "তুমি প্রভু দয়াসিন্ধু মহিমা সাগর।
কি বলিতে পারি প্রভু আমি তুচ্ছ নর।।"
➡️ সত্যনারায়ণ দয়ার মহাসমুদ্র, তাঁর মহিমা অসীম।
➡️ একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, আমি তাঁর গুণগান কীভাবে গাইব!
🔹 "আপনি রচিলে নাথ আপন কীৰ্ত্তন।
মাের দোষ ক্ষম, দেহ চরণে শরণ।।"
➡️ সত্যনারায়ণ নিজেই তাঁর কীর্তন রচনা করেন, যা ভক্তদের পরম শান্তি দেয়।
➡️ আমি ভুল করলেও, হে প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আপনার চরণে শরণ দিন।
ভক্তদের কল্যাণ ও আশীর্বাদ
🔹 "নায়কে কল্যাণ কর গায়কে সুস্বর।
আসর সহিতে সত্যপীর দেহ বর।।"
➡️ সত্যনারায়ণ ভক্তদের কল্যাণ করেন এবং যাঁরা গান গেয়ে তাঁর মহিমা প্রচার করেন, তাঁদের সুন্দর কণ্ঠ দান করেন।
➡️ এই সত্যপীরের আসর যেন শুভভাবে পরিচালিত হয়, সেই বর দিন।
🔹 "পূজার দক্ষিণা দিবে, না হবে কাতর।
তবে দয়া করিবেন পীর পয়গম্বর।।"
➡️ পূজার জন্য যথাযথ দক্ষিণা প্রদান করা উচিত, যাতে কেউ কৃপণ না হয়।
➡️ যারা উদারভাবে দান করে, সত্যনারায়ণ তাদের প্রতি কৃপা করেন।
উপসংহার
🔹 "গ্রন্থ সাঁঙ্গ হৈল বিরচিল দ্বিজ রাম।
সবে হরি ধ্বনি কর মুজ্ রা সেলাম।।"
➡️ দ্বিজ রামেশ্বর এই গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা সত্যনারায়ণের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে।
➡️ তাই সকল ভক্ত ‘হরি বল’ ধ্বনি করুন এবং সত্যনারায়ণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করুন।
মূল শিক্ষা ও বার্তা
✅ সত্যনারায়ণের ব্রতের মাহাত্ম্য – সত্যনারায়ণের ব্রত পালন করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয় এবং পরম মোক্ষ লাভ করা যায়।
✅ দয়ার আধার – সত্যনারায়ণ সকল দুঃখ ঘোচান, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে আশীর্বাদ করেন।
✅ ভক্তির মূল্য – সচ্চিত্তে ও উদারভাবে পূজা-অর্চনা করলে সত্যনারায়ণের কৃপা পাওয়া যায়।
✅ হরি ধ্বনি ও সুমতির আশীর্বাদ – সত্যনারায়ণ পূজা করলে কল্যাণ হয়, তাই ভক্তরা সবসময় হরি ধ্বনি করুক।
এই স্তোত্রটি সত্যনারায়ণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তাঁর কৃপা লাভের উপায়কে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। 🙏
অর্চ্চনং বন্দনং পাঠং নমস্কারং ক্ষমস্বতে ।
প্রসাদানন্দ সংযােগে স্তুতিং কৃত্বা গৃহং গত্বা ।।
গুণানুচিন্তয়েৎ ভক্ত্যা রাত্রৌ নিদ্রা ন লভ্যতে ।
এবং কৃতে মনুষ্যাণাং নিত্যানন্দং সুখং ভবেৎ।।
শ্লোকের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা
🔹 "অর্চ্চনং বন্দনং পাঠং নমস্কারং ক্ষমস্বতে।
প্রসাদানন্দ সংযােগে স্তুতিং কृत्वা গৃহং গত্বা।।"
➡️ সত্যনারায়ণ বা ঈশ্বরের পূজা, বন্দনা, পাঠ, এবং নমস্কার করার পর, ভক্তরা তাঁর প্রসাদ গ্রহণ করে।
➡️ তারপর ঈশ্বরের মাহাত্ম্য স্মরণ করে এবং স্তুতি করে গৃহে ফিরে যায়।
🔹 "গুণানুচিন্তয়েৎ ভক্ত্যা রাত্রৌ নিদ্রা ন লভ্যতে।
এবং কৃতে মনুষ্যাণাং নিত্যানন্দং সুখং ভবেৎ।।"
➡️ যাঁরা ভক্তিভরে সত্যনারায়ণের গুণ ও লীলার স্মরণ করেন, তাঁরা রাতেও ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থাকেন, ফলে তাঁদের মনে প্রশান্তি বিরাজ করে।
➡️ এইভাবে সত্যনারায়ণের কৃপা লাভ করলে মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী আনন্দ ও সুখ আসে।
মূল শিক্ষা ও বার্তা
✅ সত্যনারায়ণ পূজার মাহাত্ম্য – পূজা ও স্তুতি করার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রসাদ লাভ করা যায়।
✅ ভক্তির ফল – যারা ভক্তিভরে ঈশ্বরের গুণ স্মরণ করেন, তাঁদের মন সর্বদা শান্ত ও আনন্দে পূর্ণ থাকে।
✅ চিরস্থায়ী সুখ ও মোক্ষ লাভ – সত্যনারায়ণের চরণে আত্মনিবেদন করলে জীবনে চিরসুখ ও নিত্য আনন্দ লাভ হয়।
এটি সত্যনারায়ণ ব্রতের পরবর্তী করণীয় এবং পূজার সুফল সম্পর্কে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। 🙏
📜 শুভ বার্তা 📜
জয় রাম! জয় গোবিন্দ! 🙏
শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ পাঁচালীর শ্লোকের মাধ্যমে গুরু-কৃপা ও তাঁর মহিমা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গুরুদেবের চরণে আমাদের শ্রদ্ধা ও আশ্রয়, এটাই আমাদের পরম পাথেয়।
গুরুর কৃপায়ই জীবনের সত্য পথ উদ্ভাসিত হয়। ✨
আমি, গুরুভাই সুব্রত মজুমদার, আগরতলা, ত্রিপুরা, একজন স্কুল শিক্ষক ও ‘শ্রীশ্রী রামঠাকুর ও গান - গানের ভূবন’ ইউটিউব চ্যানেলের পক্ষ থেকে সকলকে প্রণাম ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে, দয়া করে জানাবেন।
সবার মঙ্গল কামনায়,
🙏 জয় গুরু, জয় সত্যনারায়ণ! 🙏

কোন মন্তব্য নেই: